“মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে”: বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর
“মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে সফল করতে উৎপাদন সক্ষমতা ও দক্ষতা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এজন্যে দরকার সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ। অনেক মানুষ জোট বেঁধে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়লেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-দারিদ্র্য দূর হতে পারে। দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে চাঙ্গা করতে ব্যাংকিং খাতের অনেক করণীয় রয়েছে। দেশের কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের যে স্বতঃস্ফূর্ততা আমি পাঁচ বছর দেখেছি, তাতে মনে হয় ব্যাংকিং খাত এটি পারবে। আর এতেই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সহজ হবে। খুলে যাবে সম্ভাবনার দ্বার। আজ মার্কেন্টাইল ব্যাংক তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা অন্যান্য ব্যাংকের জন্যেও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমি আশা করছি।”
মার্কেন্টাইল ব্যাংক আব্দুল জলিল শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান
গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এর বক্তব্য
তারিখ ঃ ২৩ নভেম্বর ২০১৩
সময় ঃ সকাল ১১.০০ ঘটিকা
স্থান ঃ পূর্বাণী হোটেল, ঢাকা।
শুরুতেই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বিশিষ্ট রাজনৈতিক প্রয়াত আব্দুল জলিলকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় রাখতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সামাজিক দায়বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের জন্যে ‘আব্দুল জলিল শিক্ষাবৃত্তি’ প্রকল্প চালু করায় আমি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এই প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত আজকের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। এই আয়োজনে বৃত্তির জন্যে মনোনীত উপস্থিত তরুণ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে জানাচ্ছি উষ্ণ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এই শিক্ষাবৃত্তি তোমাদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখুক, ভবিষ্যৎ উজ্জ¦ল করুক-এটিই কামনা করছি।
২। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও ১৬ কোটি জনসংখ্যার এক বিশাল ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এদেশের মানুষের সম্পদ অনেক কম। প্রতিনিয়ত বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পর্যাপ্ত খাদ্য ও নিরাপদ পানির অভাব, কৃষিতে নিম্ন উৎপাদনশীলতা, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন প্রবণতা, জ¦ালানি নিরাপত্তা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবেলা করে আমাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লেগাটাম-এর (বিভিন্ন দেশের সম্পদ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদির ভিত্তিতে তৈরি) সমৃদ্ধি সূচকে ভারতকে অতিক্রম করে ১০৩-তম অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। ভারত ১০৬-তম স্থানে। গত পাঁচ বছর ধরে সমৃদ্ধির আটটি সূচকের মধ্যে সাতটিতেই বাংলাদেশের অগ্রগতি ঘটেছে। গড় আয়ু, অপুষ্টি, শিশুমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন, মাধ্যমিক শিক্ষা, নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এতকিছুর পরেও দারিদ্র্য এখনও আমাদের জন্যে একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। অবশ্য সরকার দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দরিদ্র কৃষকদের নগদ সহায়তা, বিধবা, দুঃস্থ মহিলা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধী ইত্যাদি ভাতা দেয়া হচ্ছে। সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যার্জনে দেশের আর্থিক খাতের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতির মাধ্যমে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা তথা ফাইন্যান্সিয়াল ইনকুশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব ভাতাভোগীর জন্যে ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়ার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। মাত্র দশ টাকা জমায় ইতোমধ্যে এক কোটি ৩৩ লাখের মতো এ ধরনের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে।
৩। আমাদের আর্থিক খাত দারিদ্র্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন এবং সৃজনশীল কর্মসূচিগুলোতে সহায়তার পাশাপাশি একটি মানবিক ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা বদ্ধপরিকর। সে লক্ষ্যে আমরা ব্যাংকগুলোকে গরিব-অসহায় জনগোষ্ঠীর কল্যাণে তথা আর্ত-মানবতার সেবায় তাদের মুনাফার সামান্য একটি অংশ ব্যয় করার আহ্বান জানিয়েছি। ব্যাংকগুলোও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছে। গত বছর সব ব্যাংক মিলে ৩০৫ কোটি টাকার সিএসআর কার্যক্রম করেছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় ছয়গুণ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জুন পর্যন্ত) ব্যাংকগুলো সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে ২২৪ কোটি টাকা। আমি জানতে পেরেছি, ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত দেশের তৃতীয় প্রজন্মের মার্কেন্টাইল ব্যাংক শিা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া, গরিব শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র প্রদান ও অন্যান্য সামাজিক খাতে সুনির্দিষ্ট ল্য নিয়ে সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তারা সমাজের অবহেলিত ও অসহায় জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, দুঃস্থ ও গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্যে আর্থিক অনুদান প্রদানসহ বিবিধ সামাজিক দায়িত্ব পালন করার ল্েয ২০০০ সালে ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ গঠন করে। এই ফাউন্ডেশন দেশের দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ২০১০ সালে ‘আব্দুল জলিল শিাবৃত্তি’ প্রকল্প প্রবর্তন করে। এর অধীনে তারা প্রতি বছর জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১১ সালে সর্বমোট ৩৮৪ জন ছাত্র-ছাত্রীকে ৫০ লাখ টাকা এবং ২০১২ সালে ৭৫০ ছাত্র-ছাত্রীকে এক কোটি টাকা শিা বৃত্তি প্রদান করেছে। এবারের কর্মসূচিতে আরো ৭৫৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে এক কোটি টাকা শিা বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রতি বছর সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে গুণী ব্যক্তিদের পুরস্কার ও সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। তাদের এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
৪। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পথে দৃঢ় পদক্ষেপেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ। চলমান বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও গত পাঁচ বছর ধরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্জিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ক্রমান্বয়ে কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর মাস শেষে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭.০৩ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১০৪৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এমন সম্ভাবনাময় সময়ে দেশে যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক কর্মকা- এবং অধিকারের নামে বিধ্বংসী প্রবণতা বিরাজ করছে, তা দীর্ঘায়িত বা স্থায়ী হলে আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনা ম্লান হয়ে যাবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে বিনিয়োগ কমে যায়। বিনিয়োগ কমে গেলে ব্যাংকগুলোর তারল্য উদ্বৃত্ত বেড়ে যায়। খেলাপী ঋণ বেড়ে যায়। তাই আত্মঘাতী রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার দিকে চেয়ে আছে দেশের মানুষ।
৫। আমাদের সম্ভাবনা প্রচুর। বিশ্বও আজ নির্দি¦ধায় স্বীকার করছে, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে সফল করতে উৎপাদন সক্ষমতা ও দক্ষতা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এজন্যে দরকার সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ। অনেক মানুষ জোট বেঁধে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়লেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-দারিদ্র্য দূর হতে পারে। দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে চাঙ্গা করতে ব্যাংকিং খাতের অনেক করণীয় রয়েছে। দেশের কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের যে স্বতঃস্ফূর্ততা আমি পাঁচ বছর দেখেছি, তাতে মনে হয় ব্যাংকিং খাত এটি পারবে। আর এতেই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সহজ হবে। খুলে যাবে সম্ভাবনার দ্বার। আজ মার্কেন্টাইল ব্যাংক তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা অন্যান্য ব্যাংকের জন্যেও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমি আশা করছি।
৬। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে এগিয়ে নিতে ব্যাংকগুলো দেশের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ সর্বোপরি অবহেলিত জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। আজকে যারা বৃত্তি পাচ্ছো তাদের সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তোমরাই একদিন উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হবে। তোমাদের এই যাত্রাপথে রইলো আমার শুভকামনা।
পরিশেষে, ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক আব্দুল জলিল শিক্ষাবৃত্তি’ প্রদান কর্মসূচির সাফল্য কামনা করছি। এই সুন্দর আয়োজনের জন্যে কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের আবারো অভিনন্দন জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।
ধন্যবাদ সবাইকে।