টাওয়ার শেয়ার নীতিমালা উপেক্ষা বাড়ছে টাওয়ার, হচ্ছে না মানসম্পন্ন নেটওয়ার্ক
প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে মোবাইল অপারেটররা তাদের নিজস্ব টাওয়ার শেয়ারিং এ অনাগ্রহী হওয়ায় এক যুগের বেশি সময় আগে অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা করা হলেও এর উল্লেখযোগ্য কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
এ নীতিমালা প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা থাকলে নেটওয়ার্ক সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেত। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব।
নীতিমালাটি কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হলে সেবার মানও তুলনামূলক বৃদ্ধি পেত বলে জানান আলোচকরা।
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত ‘নেটওয়ার্ক উন্নয়নে অবকাঠামো ভাগাভাগির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, গত ২৫ বছরে মোবাইল অপারেটর টাওয়ার শেয়ারিং মাত্র ১৭% পৌঁছেছে।
টাওয়ার লাইসেন্সিং চালু পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের মে মাসে এ বিটিআরসি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি (মোবাইল অপারেটর-টাওয়ার কোম্পানি- মোবাইল অপারেটর) সম্পাদনের নির্দেশ দিলেও কিছু মোবাইল অপারেটর অন্য মোবাইল অপারেটর নিজস্ব টাওয়ারের শেয়ারিং করতে চাইলেও গত প্রায় ৪ বছরে কোন শেয়ারিং হয়নি।
টাওয়ার নির্মাণ বাড়ছে যা টাওয়ার শেয়ারিং এর পরিপন্থী। এর কারণে টাওয়ার কোম্পানী গুলোর প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন হচ্ছে।
আলোচকরা বলেন, এই অবস্থার মূল্য কারণ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে মোবাইল অপারেটররা তাদের নিজস্ব টাওয়ার শেয়ারিং এ অনাগ্রহী। মোবাইল অপারেটরদের প্রায় ২০ হাজার টাওয়ার এখনও শেয়ারিং এর বাইরে রয়েছে।
আলোচকরা বলছেন, নেটওয়ার্ক তৈরির প্রতিযোগিতায় অপরিকল্পিতভাবে বিটিএস স্থাপন করেছে সেলফোন অপারেটররা। গত দুই দশকে সারা দেশে অপারেটর নিজস্ব টাওয়ারে বিটিএস বসিয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার।
বর্তমানে অপারেটরগুলোর মধ্যে রবি ৩০%, গ্রামীণফোন ১৮%, বাংলালিংক ১৭% শেয়ার করছে। অপারেটরেদের হাতে থাকা ২৪ হাজার ৪২৫ টাওয়ারেরর মাত্র ১৭ % টাওয়ার শেয়ার হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
টাওয়ার শেয়ারিং না করা সরকারের নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী বলে মন্তব্য করে আলোচকরা বলেন, টাওয়ার ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন হচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ, যা চাপ তৈরি করছে জ্বালানির ওপর। অপরিকল্পিত এসব বিটিএস পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অপচয় হচ্ছে জমিরও। এগুলো পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে অপারেটরদের।
অপারেটরদের ভাগাভাগির মাধ্যমে এ সংখ্যা কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে জানিয়ে আলোচকরা বলেন, মোবাইল অপারেটররা তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন টাওয়ার ধরে রেখেছে যার ফলে নতুন টাওয়ার তৈরি হচ্ছে কিন্তু শেয়ারিং বাড়ছে না । টাওয়ার নির্মাণ বাড়ছে যা টাওয়ার শেয়ারিং এর পরিপন্থী।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, অপ্রয়োজনে একই জায়গায় একাধিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সমীচিন নয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে অবকাঠামো আমরা গড়ে তুলছি তা যেন একে অপেরর সাথে ভাগাভাগি করতে পারি। অ্যাকটিভ শেয়ারিংটা জরুরি।
মন্ত্রী বলেন, বিটিআরসি উন্নয়নের কাজ বেশি করে। যে সংকটগুলো বলা হয়েছে তা অবশ্যই সমাধানের উদে্যগ নেওয়া হবে। এমএনওগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে তাদের হাতে যে টাওয়ারগুলো আছে তা দয়া করে টাওয়ার কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দিন। কোম্পানিগুলো সেগুলো শেয়ার করুক, শেয়ার করার ক্ষেত্রে চারটি অপারেটরই যাতে নিতে পারে সে সুযোগ তৈরি করতে হবে। এরফলে এমএনওগুলোর বিনিয়োগ কম করতে হবে, যে অর্থটা তারা এভানে বিনিয়োগ করতো তা গুনগত মান উন্নয়নে ব্যয় করতে পারবে। আমাদের যে গাইডলাইন রয়েছে তা যেন মেনে চলা হয়। অ্যাকটিভ শেয়ারিং জরুরি বিষয়, এ নীতিমালা আপডেট করা হচ্ছে যা সময় নিয়ে করা হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, কোন অবস্থাতেই গ্রাহক ধরে রাখতে পারবেন না যদি সেবার মান ধরে না রাখতে পারেন। সেবার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসা করেন বা গ্রাহক বাড়ান তাতে কোনো আপত্তি নেই। মানসম্মত সেবা দিতে না পারলে টিকে থাকা যাবে না।
বিটিআরি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, আমাদের কোয়ালিটি অব সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামো ভাগাভাগিতে গ্যাপ কোথায় তা দেখতে হবে। আমােদর দেশে যারা টেলিকম সেবাদাতা তারা কেউ কেউ মাকের্ট সাইজটা বৃদ্ধি করতে মনেযাগী সেবার মান বৃদ্ধি করতে মনযোগী কম। শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে অপারেটরদের অহীনা আছে, কিছুটা সমন্বয়হীনতাও আছে। বিটিআরসি এ বিষয়ে কাজ করছে । সরকার যে সাশ্রয়ের কথা বলছে জ্বালানি ও বিদু্্যত , এ সাশ্রয় করতে গেলে শেয়ারিংটা মাস্ট। অনেক কিছুই আছে নতুন কোন নীতিমালা দরকার নেই, কিছু কিছু জায়গায় ভুলবুঝাবুঝি আছে তা সমাধান করতে হবে যা রিভিউ করা দরকার।
এছাড়া অনুষ্ঠানে রিকি স্টেইন, কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইডটকো বাংলাদেশ
হোসেন সাদাত, হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স, গ্রামীণফোন, তাইমুর রহমান, চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার, বাংলালিংক, সাহাব উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টেলিটক ,রফিকুল মতিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিটিসিএল, এমদাদুল হক, সভাপতি, আইএসপিএবি, মইনুল হক সিদ্দিকী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান, ফাইবার অ্যাট হোম
অনামিকা ভক্ত, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পেকট্রাম অ্যান্ড টেকনিক্যাল রেগুলেশন, রবি আজিয়াটা লিমিটেড বক্তব্য রাখেন।
যেভাবে নীতিমালা ও লাইসেন্স
পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব, ভূমি ও জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে এনে টাওয়ারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে এ নীতিমালা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি)। ২০১১ সালে তা সংশোধনও করা হয়।
নিজেদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে ২০১২ সালে বিটিআরসির কাছে সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠনের আবেদন করে রবি আজিয়াটা। পরবর্তীতে কমিশনের অনুমোদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড রাখা হয়।
মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় বিপুল ব্যয়ের পাশাপাশি টাওয়ারের অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা, ভূমি ও বিদ্যুতের সংকট ছাড়াও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাবসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে টাওয়ারকো লাইসেন্সও দেয় বিটিআরসি। এ লাইসেন্স হওয়ার পর অপারেটররা টাওয়ার তৈরি করতে পারছে না।
চার প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল ফোন টাওয়ার শেয়ারিংয়ের লাইসেন্স দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ইডটকো বাংলাদেশ, সামিট টাওয়ারস লিমিটেড, কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
অবকাঠামো ও টাওয়ার শেয়ারিং এর বর্তমান চ্যালেঞ্জ
• মোবাইল সেবার পঁচিশ বছর পার হওয়া সত্বেও মোবাইল অপারেটররা টাওয়ার মালিকানা কে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হিসেবে গণ্য করছে।
• সামগ্রিক নেটওয়ার্ক এর গুণমান এর উন্নয়ন , পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, বৈদেশিক মুদ্রার সংরক্ষণ , আধুনিক টাওয়ার নির্মাণ, উদ্ভাবনী টাওয়ার নির্মাণ, কামোফ্লাজ বা লুক্কায়িত টাওয়ার তৈরী, ব্যায় সংকোচন , সার্বজনীন কানেক্টিভিটি এর মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।
• মোবাইল অপারেটররা তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন টাওয়ার ধরে রেখেছে যার ফলে নতুন টাওয়ার তৈরি হচ্ছে কিন্তু শেয়ারিং বাড়ছে না
• মোবাইল অপারেটররা টাওয়ার শেয়ার রোল ব্যাক এর জন্য শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে
• টাওয়ার নির্মাণ বাড়ছে যা টাওয়ার শেয়ারিং এর পরিপন্থী। এর কারণে টাওয়ার কোম্পানী গুলোর প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।
• সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। টাওয়ার নির্মাণ বা টাওয়ার শেয়ারিং না করা সরকারের নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী।
• টাওয়ারের দ্রুত বৃদ্ধি জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ এর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আলোচনায় সুপারিশসমূহ
• টাওয়ার শেয়ারিং এ বাধ্য করতে বিটিআরসির কঠোর হওয়া
• বিদ্যমান অবকাঠামো ভাগাভাগি নির্দেশিকার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ
• ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (MNO-TowerCo-MNO) সম্পাদনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া
• কোনো একটি স্থানে যদি কোনো অপারেটর বা টাওয়ার কোম্পানী এর টাওয়ার থাকে, কোনো টাওয়ার কোম্পানি তার এক কিলোমিটার (উদাহরণ হিসেবে) এর মধ্যে বিটিআরসি এর পূর্বানুমতি ব্যতীত কোনো টাওয়ার নির্মাণ করতে পারবে না এবং নিকটস্থ টাওয়ার শেয়ার বাধ্যতামূলক হিসেবে জনস্বার্থেই দ্রুততার সাথে রেগুলেশন অতীব জরুরী। যথাযথ এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেই শুধু মাত্র টাওয়ার কোম্পানী গুলোকে টাওয়ার নির্মাণ এর অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
• সামাজিক বাধ্যবাধকতা তহবিল বা Social Obligation Fund ব্যবহার করে টেলিটক হাওর এলাকায় টাওয়ার তৈরী করছে যা একটি যুগান্তরী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপটি আরো যুগান্তকারী হবে এবং দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে যদি টেলিটক অন্য অপারেটরদের সাথে টাওয়ার গুলো শেয়ার করে।
• অবকাঠামো সংক্রান্ত শেয়ার করার সক্ষমতা তথ্যসহ বিশদ তথ্যাদি সকল লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিমাসে হালনাগাদ করে প্রকাশ নিশ্চিত করা
• টাওয়ার শেয়ারিং এর নিমিত্তে মোবাইল অপারেটরদের নিজস্ব টাওয়ারগুলির জন্য সাইট সার্ভে করার সময় টাওয়ারকো এবং শেয়ারিং প্রত্যাশী মোবাইল অপারেটর কর্তৃক যৌথ জরিপের বিধান প্রণয়ন
• বিটিআরসি কর্তৃক কোন মোবাইল অপারেটর দ্বারা শেয়ারিং প্রত্যাখ্যাত সাইটগুলি যথেচ্ছভাবে অডিট করা যেতে পারে এবং এই ধরণের সাইটগুলোকে স্থায়ীভাবে শেয়ারযোগ্য না হিসেবে ঘোষণা করে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যেতে পারে
• টাওয়ার কোম্পানি নতুন টাওয়ার স্থাপন ও বর্তমান টাওয়ার স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ন্যূনতম তিনটি মোবাইল অপারেটর এর সাথে টাওয়ার শেয়ার করা যায় এমন সক্ষমতাসহ টাওয়ার স্থাপনের বিধান প্রণয়ন
• মোবাইল অপারেটরদের আইবিএস শেয়ারিং বাধ্যতামূলক করা
Press Release
Dhaka, July 21, 2022